আধুনিক জীবনযাত্রা, অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন, এ সবের কারণে যে অসুখগুলি সবচেয়ে বেশি সমস্যায় ফেলে, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়া তাদের অন্যতম। এমনিতে আপনার এমন সমস্যা আছে কি না তা বুঝতে গেলে রক্ত পরীক্ষা করাই দস্তুর।
কিন্তু চিকিৎসকদের মতে, এই অসুখের প্রবণতা আপনার আছে কি না, বা
ইতিমধ্যেই আপনার রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে গিয়েছে কি না তা বুঝতে সব
সময় রক্তপরীক্ষা পর্যন্ত অপেক্ষা করার প্রয়োজন হয় না। বরং কিছু উপসর্গ
দেখলে বোঝা যায় শরীরে এই রোগ বাসা বেঁধেছে কি না।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সুবর্ণ গোস্বামীর মতে, “রক্তে বেশি কোলেস্টেরল
এলেই শারীরিক নানা সমস্যা শুরু হতে পারে।এর প্রভাব শরীরের বহিরঙ্গেও দেখা
দেয়। তাই একটু সচেতন হলেই বুঝে যাওয়া যায় কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ছে কি
না।’’
উপসর্গ
·চোখের নীচে বা চোখেরপাতায় সাদাটে বা হলদেটে ব্যথাহীন ফোলাঅংশ
দেখা দিলে দ্রুত রক্ত পরীক্ষাকরান। এতে চোখের কোনও সমস্যা দেখা না দিলেও এটি রক্তে
কোলেস্টেরল থাকারএকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপসর্গ।
·কিছু দিন ধরে মাঝেমাঝে বুকে ব্যথা হচ্ছে, অথচ ইসিজি
রিপোর্টে তেমন কিছু সমস্যা খুঁজে পাননি? এমন হলে এক বার রক্ত পরীক্ষা করিয়ে দেখে নিন রক্তে
কোলেস্টেরল প্রবেশ করেছেকি না। আসলে উচ্চ কোলেস্টেরল থাকলে রক্তনালীতে অক্সিজেন
সরবরাহ কমে।পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাবে হৃদযন্ত্রে চাপ পড়ে বুকে ব্যথা
হতে পারে।
·কোলেস্টেরল জমলে মস্তিষ্কেও রক্ত সঞ্চালন কমে। এই কারণে
ঘাড়ে ও মস্তিষ্কের পিছনের দিকে মাঝে মাঝে একটানা ব্যথা হয়।
·শারীরিক পরিশ্রম করলে বাকোনও উদ্বেগের
কারণে হৃদস্পন্দনের হার বেড়ে যেতেই পারে। কিন্তু কোনও কারণছাড়া মাঝে মাঝেই
কি হৃদগতি বেড়ে যায়। এমনটা হলে আর সময় নষ্ট না করে রক্তপরীক্ষা করান।
কোলেস্টেরল হৃদগতিকে বাড়িয়ে দেয়।
·খুব ভাল করে
লক্ষ্যকরে দেখুন তো, চোখের মণির চারপাশে ধূসর রঙের কোনও গোল দাগ দেখা যাচ্ছে? তাহলে জানবেন, তা চোখের সমস্যা নয়, বরং কোলেস্টেরলের কারণেই এমনটা হচ্ছে। তাইদেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
আপনি কি কোলেস্টেরল পরীক্ষা করিয়েছেন? পরীক্ষার পর কি কোলেস্টেরলের
পরিমাণ বেশি ধরা পড়েছে? যদি সেটা বেশি হয়ে থাকে, তাহলে আপনি জেনে খুশি হবেন
যে কিছু খাবার রয়েছে যেগুলো সত্যিই কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে বেশ কাজে দেয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজনের ক্ষেত্রে শরীরে
কোলেস্টেরলের আধিক্য দেখা দিতে পারে। কোলেস্টে
কোলেস্টেরল এক ধরনের চর্বি। এটি দেখতে অনেকটা মোমের মতো নরম। এটি আমাদের
দেহের কোষের দেয়ালে থাকে। আমরা যখন চর্বিজাতীয় খাবার খাই, তখন আমাদের যকৃতে
এই কোলেস্টেরল তৈরি হয় এবং রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে আমাদের দেহের সমস্ত
রক্তনালিতে ছড়িয়ে পড়ে। এটি শরীরের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন কাজে সাহায্য করে।
যেমন : হরমোন তৈরিতে, চর্বিতে দ্রবনীয় ভিটামিনগুলোর পরিপাকে এবং ভিটামিন ডি
তৈরিতে।
যদি অধিক পরিমাণ চর্বিজাতীয় খাবার খাওয়া হয় তবে এই অতিরিক্ত কোলেস্টেরল
ধমনির দেয়ালে জমাট বেঁধে প্লাক তৈরি করে এবং রক্ত চলাচলে বাধা দেয়। ফলে
বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা যায়। যেমন : উচ্চ রক্তচাপ, হৃৎপিণ্ডের
নানা ধরনের অসুখ, হার্ট অ্যাটাক ইত্যাদি।
সাধারণত দুই ধরনের কোলেস্টেরল আছে। একটি লো ডেনসিটি লাইপো প্রোটিন (এলডিএল) এবং অপরটি হাইডেনসিটি লাইপো প্রোটিন (এইচডিএল)।
এলডিএল ধমনির দেয়ালে ক্ষতিকর প্লাক তৈরিতে সাহায্য করে, তাই একে খারাপ
কোলেস্টেরল বলা হয়। আর এইচডিএল ধমনির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় এলডিএল
কোলেস্টেরলকে সরিয়ে দিতে সাহায্য করে। ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে। এ জন্য
এটিকে ভালো কোলেস্টেরল বলা হয়। রক্তে এলডিএলের স্বাভাবিক মাত্রা হলো
কমপক্ষে ১০০ মিলিগ্রাম পার ডিএল। এইচডিএলের স্বাভাবিক মাত্রা ৪০ থেকে ৬০ বা
তার বেশি মিলিগ্রাম পার ডিএল।
রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে যে ধরনের খাবার খেতে হবে
১. জলপাইয়ের তেল এবং জলপাইয়ের তৈরি খাদ্য
অলিভ অয়েল বা জলপাইয়ের তেলে রয়েছে মনো-আনসেচুরেটেড ফ্যাটি এসিড ও ভিটামিন
ই। গবেষণায় দেখা গেছে, মনো-আনসেচুরেটেড ফ্যাটি এসিড দেহের খারাপ কলেস্টেরল
এলডিএলকে কমায় এবং ভালো কোলেস্টেরল এইচডিএলকে বাড়াতে সাহায্য করে। তাই যদি
কেউ দেহের ভালো কোলেস্টেরলকে বাড়িয়ে খারাপ কোলেস্টেরলকে কমাতে চায়, তার
জলপাইয়ের তেল বা জলপাইয়ের তৈরি খাবার অবশ্যই খেতে হবে।
প্রতিদিন খাবারে এক অথবা দুই চামচ জলপাইয়ের তেল সালাদ বা রান্নায় ব্যবহার করলে শরীরে মনো-আনসেচুরেটেড ফ্যাটি এসিডের চাহিদা পূরণ হবে।
রল নিয়ন্ত্রণে কিছু খাদ্যের
বিষয়ে জানিয়েছে স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইট হেলথ টোয়েন্টিফোর। তবে এর আগে আসুন
জেনে নিই কোলেস্টেরল আসলে কী। ২. সবজি
সবজি দেহের কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমায় এবং শক্তি জোগাতে সাহায্য করে। এ
জাতীয় খাবার যেমন: শুষ্ক সোয়া প্রোডাক্ট, মটরশুটি, টফু ইত্যাদি।
৩. ননি ছাড়া দই এবং দুগ্ধজাত খাদ্য
যদি আপনি রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণকে কমাতে চান, তাহলে ননিযুক্ত দুগ্ধজাত
খাবার বাদ দিতে হবে। এর মানে এই নয় যে আপনি দুধের তৈরি খাবার খাবেন না। যদি
দুগ্ধজাত খাবার না খাওয়া হয় তবে ক্যালসিয়াম, মিনারেল এ ধরনের প্রয়োজনীয়
উপাদান থেকে শরীর বঞ্চিত হবে। এগুলো মানব শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের
কার্যক্ষমতাকে সক্রিয় রাখে। দুধের তৈরি খাবার অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ক্ষয়
প্রতিরোধেও দারুণ সাহায্য করে।
তাই দুধের তৈরি খাবার খেতে হবে। তবে সেটি হবে ননি ছাড়া। ননিবিহীন দই বিশেষত
প্রোটিনের জন্য খুব ভালো উৎস্য। এ ছাড়া এ থেকে আপনি পেতে পারেন
ক্যালসিয়াম, ল্যাকটোব্যাসিলাস মাইক্রো-অর্গানিজম; যেগুলো কোলেস্টেরল
নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে।
৪. অ্যান্টি অক্সিডেন্ট-সম্বৃদ্ধ ফল ও সবজি
সব ধরনের সবজি ও ফল আপনার কোলেস্টেরলের মাত্রাকে কমাতে সাহায্য করে। বিশেষত
যেসব সবজিতে ভিটামিন সি ও বিটা ক্যারোটিন রয়েছে সেগুলো বেশি খেতে হবে।
ভিটামিন সি : ভিটামিন সি রয়েছে সব ধরনের সাইট্রাস ফলে।
যেমন : কমলা, গ্রেপফল, লেবু ইত্যাদি। সব ধরনের বেরি জাতীয় ফল। যেমন :
ক্র্যানবেরি, স্ট্রবেরি, ব্ল্যাকবেরি ইত্যাদি। পেয়ারা ও আমের মধ্যেও
ভিটামিন সি পাওয়া যায়। এ ছাড়া ক্যাবেজ বা পাতাকপি পরিবারের খাবারেও আছে
ভিটামিন সি। যেমন : সবুজ বা চায়নিজ পাতাকপি, ব্রকোলি ইত্যাদি। ভিটামিন
সি-এর আরেকটি ভালো উৎস হচ্ছে মরিচ। বিটা ক্যারোটিন : গাঢ় হলুদ ফলে বিটা ক্যারোটিন রয়েছে।
যেমন : আম, হলুদ পিচফল, কাঁঠাল ইত্যাদি। সবজির মধ্যে যেমন : কুমড়া, মিষ্টি
আলু, কাঠবাদাম, গাজর ইত্যাদির মধ্যেও বিটা ক্যারোটিন রয়েছে। এ ছাড়া গাঢ়
সবুজ সবজি যেমন : ব্রকোলি, পাতাকপি ইত্যাদি খেতে হবে শরীরে বিটা
ক্যারোটিনের চাহিদা পূরণ করার জন্য।
যদি আপনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন এবং কোলেস্টেরল বৃদ্ধি পায় তবে অবশ্যই নিয়মিত খাদ্যতালিকায় এগুলো রাখতে হবে। ৫. রসুন এবং অন্যান্য পেঁয়াজ পরিবারের সদস্য
সুস্বাস্থ্যের জন্য রসুন খাওয়ার ইতিহাস বহু পুরোনো। গবেষকরা বলছেন, রসুন,
পেঁয়াজ ও পেঁয়াজজাতীয় খাবার শরীরে বাজে কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমায় এবং
হৃৎপিণ্ডকে ভালো রাখে। তরকারি ও সালাদে আমরা এটি ব্যবহার করতে পারি। এগুলো
বেশ হৃৎপিণ্ডবান্ধব খাদ্য।
৬. অপ্রক্রিয়াজাত দানাজাতীয় খাবার
সব ধরনের অপ্রক্রিয়াজাত দানাজাতীয় খাবারে ভিটামিন বি ও মিনারেলস রয়েছে।
এগুলো চর্বি ও কোলেস্টেরল কমায়। এ ধরনের খাদ্য যেমন : রুটি, গম, ভুট্টা,
ওটমিলস ইত্যাদি। ওটস-এর মধ্যে রয়েছে হাই সলিউবল ফাইবার যা কোলেস্টেরল
নিয়ন্ত্রণে বেশ কার্যকর।
৭. মাছ
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা সপ্তাহে তিনদিন অথবা এর বেশি সময় মাছ খায়, তাদের
শরীরে খারাপ কলেস্টেরল কম থাকে। যারা উচ্চ রক্তচাপ এবং বিভিন্ন হৃদরোগে
ভুগছেন তাদের জন্য মাছ খুব উপকারী। এর মধ্যে হাই ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড
রয়েছে।
৮. ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড-জাতীয় খাদ্য
আগেই বলা হয়েছে, ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড শরীরে কোলেস্টেরল কমাতে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা রাখে। তবে দুর্ভাগ্যবশত অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা শরীরের চাহিদা
অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণে এই খাবার খাই না। এখন বিভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়াজাত
খাদ্যে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড ব্যবহার করা হয়। শিমজাতীয় খাদ্য, ওয়ালনাট,
জলপাই ইত্যাদির মধ্যে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায়।
এই খাবারগুলো নিয়মিত আপনার খাদ্য তালিকায় রেখে শরীরে কোলেস্টেরলের পরিমাণকে নিয়ন্ত্রণে রাখুন।